আগামীতে দক্ষ কর্মীবাহিনী গড়ে তুলতে বৃত্তিমূলক ও কারিগরি শিক্ষা আরও গুরুত্বপূর্ণ। সরকার পাঠ্যক্রমকে আন্তর্জাতিক মানে উন্নীত এবং শিক্ষাকে আধুনিক ও বিজ্ঞানভিত্তিক করতে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিচ্ছে। বাংলাদেশে আইসিটি উন্নয়নের পন্থা এখন বিশ্বে মডেল হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাংলাদেশের ছেলেমেয়েরা মেধাবী এবং সুযোগ পেলে তা তারা প্রমাণ করতে ছিলেন দেশের সরকারী বেসরকারী কারিগরি ও বত্তিমূলক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক, কর্মকর্তাসহ সংশ্লিষ্টরা। বিদেশে কর্মরত বাংলাদেশীরা ‘অপমান ও অবহেলার’ শিকার হলে তা সহ্য করা হবে না মন্তব্য করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমার দেশের মানুষ অন্য দেশে গিয়ে অবহেলার শিকার কিংবা অপমানিত হবেন, এটা অনেকে সহ্য করতে পারলেও আমি পারব না। বিদেশে বাংলাদেশী নাগরিকদের
কর্মক্ষেত্রে ‘উপার্জন ও মর্যাদা’ বৃদ্ধিতে কারিগরি শিক্ষার ওপর গুরুত্ব দিয়ে তিনি বলেন, পাসের হারে প্রতিবেশী দেশের সমপর্যায়ে পৌঁছতে হবে। মধ্যপ্রাচ্যসহ বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশের প্রায় ৮৭ লাখ শ্রমিক কাজ করেন, যাদের অধিকাংশই কারিগরিভাবে ‘অদক্ষ’ শ্রমিক। তাই তাদের আয়ও তুলনামূলকভাবে কম। প্রধানমন্ত্রী এ প্রসঙ্গে বলেন, একজন স্কুল মাস্টার, উনি হয়ত বিদেশে চলে গেছেন। কিন্তু উনাকে সেখানে গিয়ে কি কাজ করতে হচ্ছে? তাকে হয়ত দোকানির কাজ করতে হচ্ছে। অথবা আমাদের ছেলেদের দেখেছি, কোন কোন দেশে গিয়ে রাস্তায় ময়লা কুড়োচ্ছে। এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য আওয়ামী লীগ সরকার নানা ধরনের প্রশিক্ষণ ও কারিগরি শিক্ষার উদ্যোগ নিয়েছে। এখন প্রতিটি ক্ষেত্রে কে কোথায় যাবে, কোন্্ ধরনের শিক্ষা নেবে, কী ধরনের ট্রেনিং দরকার- আমরা এখন সেগুলো দিয়ে দিচ্ছি। এটা কিন্তু অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। দক্ষতা নিয়ে যদি কেউ যায়, তাহলে অধিক অর্থ উপার্জন করতে পারবে, কর্মক্ষেত্রে তাদের একটা গুরুত্ব থাকবে। অবহেলার শিকার হবেন না, কেউ তাদের অবহেলা করতে পারবে না। প্রধানমন্ত্রী আশা প্রকাশ করেণ্ড মানবসম্পদের যথাযথ ব্যবহার করে বাংলাদেশকেও সুইজারল্যান্ডের মতো উন্নত-সমৃদ্ধ দেশ হিসেবে গড়ে তোলা সম্ভব। তিনি বলেন, জাতির জনক সবসময় বলতেন, বাংলাদেশকে গড়ে তুলবেন প্রাচ্যের সুইজারল্যান্ড হিসেবে। সুইজারল্যান্ডই হচ্ছে পরিপূর্ণ, সব থেকে শান্তিপূর্ণ দেশ, সব থেকে অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী দেশ। তারাও ধীরে ধীরেই নিজেদের সেভাবে গড়ে তুলেছে। কাজেই আমরা সেভাবে নিজেদের গড়ে তুলতে পারব। ভৌগোলিক দিক থেকে হয়ত আমাদের ভূখ- এত বড় না, কিন্তু জনসংখ্যার দিক থেকে বিশাল। আমাদের দেশের মানুষকে যদি গড়ে তুলতে পারি তাহলে বাংলাদেশ কেন পিছিয়ে থাকবে? কেন অন্যের কাছে হাত পাততে হবে? কেন আমরা নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারব না? তবে এজন্য শিক্ষাকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে।
শেখ হাসিনা আরও বলেন, বিজ্ঞান শিক্ষার প্রসার ঘটাতে হবে। আমরা সবসময় বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও কারিগরি শিক্ষার ওপর গুরুত্ব আরোপ করি। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞানসম্মত জ্ঞান ও তথ্য প্রযুক্তি সমৃদ্ধ একটি জাতি গঠন করতে চেয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধু ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্ট সরকারের শিল্পমন্ত্রীর দায়িত্ব পালনকালে তাঁর উদ্যোগে ঢাকা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠিত হয়। স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু শিক্ষা ব্যবস্থার পুনর্গঠনে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেন। বঙ্গবন্ধু কুদরাত-এ-খুদা শিক্ষা কমিশন গঠন ও প্রাথমিক শিক্ষাকে জাতীয়করণ করেন। তিনি একটি সমৃদ্ধ জনশক্তি গঠনে মানবসম্পদ উন্নয়ন পরিকল্পনার প্রস্তুতি গ্রহণ করেন। ১৯৭৫ সালে তাঁর নির্মম হত্যাকা-ের পর তাঁর সকল লক্ষ্য ও উন্নয়ন কর্মসূচী ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং দেশ ২১ বছরের জন্য গণতন্ত্র ও উন্নয়নবিহীন ঐতিহাসিক কালো অধ্যায়ে প্রবেশ করে।
শিক্ষকদের সমস্যা সমাধানে সরকারের আন্তরিকতার কথা তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বৃত্তিমূলক শিক্ষার মান উন্নয়ন ও শিক্ষকদের সমস্যা সমাধানে তার সরকার অত্যন্ত আন্তরিক। দীর্ঘ সংগ্রামের পর জনগণ পুনরায় তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগের সুযোগ পায় এবং আওয়ামী লীগ ১৯৯৬ সালে নির্বাচিত হয়ে ক্ষমতায় আসে। দীর্ঘ সময় পরে ‘দেশবাসী বুঝতে পারে যে তাদের কল্যাণ ও উন্নয়নের জন্যই সরকার। প্রধানমন্ত্রী উল্লেখ করেন, তাঁর সরকার যথাসম্ভব উন্নয়ন ইস্যুগুলোতে সর্বদা বঙ্গবন্ধুর পথ অনুসরণ করছে। প্রতি খাতের মতো আওয়ামী লীগ সরকার কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষার ওপর গুরুত্ব দিয়ে গোটা শিক্ষা ব্যবস্থায় সংস্কার সাধন করেছে। এর অংশ হিসেবেই সরকার প্রতিটি জেলায় পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত নেয় এবং এই কর্মসূচীর আওতায় ১৯৯৬ সালে তাঁর সরকার প্রাথমিক পর্যায়ে ১৮টি ইনস্টিটিউট নির্মাণ করেছে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, তাঁর সরকার ২০২০ সাল নাগাদ মাধ্যমিক স্তরে কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষায় ২০ শতাংশ শিক্ষার্থী বৃদ্ধির পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কম্পিউটার ও আইসিটি শিক্ষার সুযোগ সৃষ্টি করা হবে। এ লক্ষ্যে সরকার সর্বাত্মক প্রস্তুতি গ্রহণ করেছে। দেশের শিক্ষার অগ্রগতির কথা তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, যে পাসের হার ৪০ থেকে ৪৫ ভাগ হতো, সেটা এখন ৯২ ভাগের ওপর পৌঁছেছে। আরও অনেক দূর যেতে চাই আমরা। পাশের দেশে ৯৮ দশমিক ৮ ভাগ পাস করে। প্রতিবেশী দেশে যদি এত পাস করে, আমাদের দেশের ছেলেমেয়েরা পারবে না কেন? আমি তো মনে করি আমাদের দেশের ছেলেমেয়েরা অনেক বেশি মেধাবী। অনুষ্ঠানে শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ বলেন, কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষার প্রতি আগে আগ্রহ না থাকলেও সরকারের নানা ধরনের চেষ্টায় এই শিক্ষার প্রতি আগ্রহ বাড়ছে।
দেশজুড়ে নানা আয়োজন
শিক্ষা মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, আগামী ২৪ জুন পর্যন্ত চলবে কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষা সপ্তাহ। প্রধানমন্ত্রীর উদ্বোধনের পরই প্রথমদিন বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে অনুষ্ঠিত হয়েছে সেমিনার। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থানমন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার খন্দকার মোশাররফ হোসেন। কেন্দ্রীয় আয়োজনের মধ্যে আছে কয়েকটি সেমিনার। আজ বিকেল ৩টায় কাকরাইলস্থ আইডিইবি মিলনায়তনে সেমিনার অনুষ্ঠিত হবে। আগামীকাল সকাল সাড়ে ৮টায় শিক্ষামন্ত্রীর নেতৃত্বে ছাত্র, শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারীসহ জাতীয় গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গের অংশগ্রহণে র্যালি জাতীয় জাদুঘর থেকে শুরু হয়ে শিশুপার্ক- মৎস্যভবন-প্রেসক্লাব- শিক্ষাভবন-দোয়েলচত্বর হয়ে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে শেষ হবে। শনিবার বিকেল ৩টায় ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে ‘একুশ শতকের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষা’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠক। রবিবার বেলা ১১টায় সিরডাপ মিলনায়তনে ‘বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিমনস্ক জাতি গঠনে কারিগরি শিক্ষা: সরকারি ও বেসরকারী উদ্যোগ’ শীর্ষক সেমিনার।
সোমবার বিকেল সাড়ে ৩টায় এলজিইডি ভবনের আরডিইসি সেমিনার হলে ‘কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষায় নারীর অংশগ্রহণ ও সামাজিক গ্রহণযোগ্যতা : সমস্যা ও সম্ভাবনা’ শীর্ষক সেমিনার। এছাড়া ২৪ জুন মঙ্গলবার বিকাল ৩টায় আইডিইবি মিলনায়তনে ‘শিল্পকারখানা ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সম্পর্ক উন্নয়নের প্রতিবন্ধকতা ও করণীয়’ শীর্ষক সমাপনী সেমিনার অনুষ্ঠিত হবে। দেশের সকল জেলা-উপজেলায় প্রায় একই ধরনের কর্মসূচী পালন করা হবে।